Header Ads

Header ADS

অতিথির স্মৃতি: অষ্টম শ্রেণির বাংলা বই ২০২৫ - পর্ব ১

 অষ্টম শ্রেণির বাংলা বই ২০২৫-এর "অতিথির স্মৃতি" গদ্যের বিস্তারিত বিশ্লেষণ ও পর্ব ১ এর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু জানুন।


অতিথির স্মৃতি

- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

“চিকিৎসকের আদেশে দেওঘরে এসেছিলাম বায়ু পরিবর্তনের জন্যে | প্রাচীর ঘেরা বাগানের মধ্যে একটা বড় বাড়িতে থাকি | রাত্রি তিনটে থেকে কাছে কোথাও একজন গলাভাঙা  একঘেয়ে সুরে ভজন শুরু করে, ঘুম ভেঙে যায়, দোর খুলে বারান্দায় এসে বসি | ধীরে ধীরে রাত্রি শেষ হয়ে আসে- পাখিদের আনাগোনা শুরু হয় । দেখতাম ওদের মধ্যে সবচেয়ে ভোরে ওঠে দোয়েল | অন্ধকার শেষ না হতেই তাদের গান আরম্ভ হয়, তারপরে একটি দুটি করে আসতে থাকে বুলবুলি, শ্যামা, শালিক, টুনটুনি পাশের বাড়ির আমগাছে, এ বাড়ির বকুল-কুঞ্জে, পথের ধারের অশ্বখগাছের মাথায়-- সকলকে চোখে দেখতে পেতাম না, কিন্তু প্রতিদিন ডাক শোনার অভ্যাসে মনে হতো যেন ওদের প্রত্যেককেই চিনি | হলদে রঙের একজোড়া বেনে-বৌ পাখি একটু দেরি করে আসত | প্রাচীরের ধারের ইউক্যালিপটাস গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালটায় বসে তারা প্রত্যহ হাজিরা হেঁকে যেত | হঠাৎ কী জানি কেন দিন-দুই এলো না দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম, কেউ ধরলে না তো? এদেশে ব্যাধের অভাব নেই, পাখি চালান দেওয়াই তাদের ব্যবসা- কিন্তু তিন দিনের দিন আবার দুটিকে ফিরে আসতে দেখে মনে হলো যেন সত্যিকার একটা ভাবনা ঘুচে গেল।”

এমনি করে সকাল কাটে | বিকালে গেটের বাইরে পথের ধারে এসে বসি | নিজের সার্মথ্য নেই বেড়াবার, যাদের আছে তাদের প্রতি চেয়ে চেয়ে দেখি | দেখতাম মধ্যবিত্ত গৃহস্থের ঘরে পীড়িতদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই ঢের বেশি | প্রথমেই যেত পা ফুলো-ফুলো অল্পবয়সী একদল মেয়ে ৷ বুঝতাম এরা বেরিবেরির আসামি ৷ ফোলা পায়ের লজ্জা ঢাকতে বেচারাদের কত না যত্ন | মোজা পরার দিন নয়, গরম পড়েছে, তবু দেখি কারও পায়ে আঁট করে মোজা পরা | কেউ বা দেখলাম মাটি পর্যন্ত লুটিয়ে কাপড় পরেছে- সেটা পথ চলার বিঘ্ন, তবু, কৌতূহলী লোকচক্ষু থেকে তারা বিকৃতিটা আড়াল রাখতে চায় । আর সবচেয়ে দুঃখ হতো আমার একটি দরিদ্র ঘরের মেয়েকে দেখে ৷ সে একলা যেত | সঙ্গে আত্মীয়-স্বজন নেই, শুধু তিনটি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে | বয়স বোধ করি চব্বিশ-পঁচিশ, কিন্তু দেহ যেমন শীর্ণ, মুখ তেমনি পান্ডুর- কোথাও যেন এতটুকু রক্ত নেই। শক্তি নেই নিজের দেহটাকে টানবার, তবু সবচেয়ে ছোটো ছেলেটি তার কোলে | সে তো আর হাটতে পারে না অথচ,ফিরে আসবারও ঠাই নেই? কী ক্লাস্তই না মেয়েটির চোখের চাহনি |

সেদিন সন্ধ্যার তখনও দেরি আছে, দেখি জনকয়েক বৃদ্ধ ব্যক্তি ক্ষুধা হরণের কর্তব্যটা সমাধা করে যথাশত্তি দ্রুতপদেই বাসায় ফিরছেন। সম্ভবত এরা বাতব্যাধিগ্রস্ত, সন্ধ্যার পূর্বেই এদের ঘরে প্রবেশ করা প্রয়োজন | তাদের চলন দেখে ভরসা হলো, ভাবলাম যাই, আমিও একটু ঘুরে আসিগে ৷ সেদিন পথে পথে অনেক বেড়ালাম | অন্ধকার হয়ে এলো, ভেবেছিলাম আমি একাকী, হঠাৎ পেছনে চেয়ে দেখি একটি কুকুর আমার পেছনে চলেছে | বললাম, কী রে, যাবি আমার সঙ্গে? অন্ধকার পথটায় বাড়ি পর্যন্ত পৌছে দিতে পারবি? সে দূরে দাড়িয়ে ল্যাজ নাড়তে লাগল | বুঝলাম সে রাজি আছে | বললাম, তবে আয় আমার সঙ্গে | পথের ধারের একটা আলোতে দেখতে পেলাম কুকুরটার বয়স হয়েছে; কিন্তু যৌবনে একদিন শক্তিসামর্থ্য ছিল। তাকে অনেক কিছু প্রশ্ন করতে করতে বাড়ির সমুখে এসে পৌছলাম। গেট খুলে দিয়ে ডাকলাম, ভেতরে আয় | আজ তুই আমার অতিথি | সে বাইরে দাড়িয়ে ল্যাজ নাড়তে লাগল, কিছুতে ভেতরে ঢোকার ভরসা পেল না। আলো নিয়ে চাকর এসে উপস্থিত হলো, গেট বন্ধ করে দিতে চাইল, বললাম, না, খোলাই থাক | যদি আসে, ওকে খেতে দিস | ঘণ্টাখানেক পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম সে আসে নি-_ কোথায় চলে গেছে |

পরদিন সকালে বাইরে এসেই দেখি গেটের বাইরে দাড়িয়ে আমার সেই কালকের অতিথি | বললাম, কাল তোকে খেতে নেমন্তন করলাম, এলিনে কেন?

জবাবে সে মুখপানে চেয়ে তেমনি ল্যাজ নাড়তে লাগল | বললাম, আজ তুই খেয়ে যাবি, না খেয়ে যাসনে বুঝলি? প্রত্যুত্তরে সে শুধু ঘন ঘন ল্যাজ নাড়ল- অর্থ বোধ হয় এই যে, সত্যি বলছো তো?

রাত্রে চাকর এসে জানাল সেই কুকুরটা এসে আজ বাইরের বারান্দার নিচে উঠানে বসে আছে। বামুনঠাকুরকে ডেকে বলে দিলাম, ও আমার অতিথি, ওকে পেট ভরে খেতে দিও |

পরের দিন খবর পেলাম অতিথি যায় নি। আতিথ্যের মর্যাদা লঙ্ঘন করে সে আরামে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে | বললাম, তা হোক, ওকে তোমরা খেতে দিও |

আমি জানতাম, প্রত্যহ খাবার তো অনেক ফেলা যায়, এতে কারও আপত্তি হবে না । কিন্তু আপত্তি ছিল এবং অত্যন্ত গুরুতর আপত্তি । আমাদের বাড়তি খাবারের যে প্রবল অংশীদার ছিল এ বাগানের মালির মালিনী- এ আমি জানতাম না। তার বয়স কম, দেখতে ভালো এবং খাওয়া সম্বন্ধে নির্বিকারচিত্ত। চাকরদের দরদ তার পরেই বেশি৷ অতএব, আমার অতিথি করে উপবাস | বিকালে পথের ধারে গিয়ে বসি, দেখি অতিথি আগে থেকেই বসে আছে ধুলোয় | বেড়াতে বার হলে সে হয় পথের সঙ্গী, জিজ্ঞাসা করি, হ্যাঁ অতিথি, আজ মাংস রান্না্টা কেমন হয়েছিল রে? হাড়গুলো চিবোতে লাগল কেমন? সে জবাব দেয় ল্যাজ নেড়ে, মনে করি মাংসটা তা হলে ওর ভালোই লেগেছে | জানিনে যে মালির বউ তারে মেরেধরে বার করে দিয়েছে- বাগানের মধ্যে ঢুকতে দেয় না, তাই ও সমুখের পথের ধারে বসে কাটায় । আমার চাকরদেরও তাতে সায় ছিল |

হঠাৎ শরীরটা খারাপ হলো, দিন-দুই নিচে নামতে পারলাম না । দুপুরবেলা উপরের ঘরে বিছানায় শুয়ে, খবরের কাগজটা যেইমাত্র পড়া হয়ে গেছে, জানালার মধ্য দিয়ে বাইরের রৌদ্রতপ্ত নীল আকাশের পানে চেয়ে অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছিলাম | সহসা খোলা দোর দিয়ে সিঁড়ির উপর ছায়া পড়ল কুকুরের | মুখ বাড়িয়ে দেখি অতিথি দাড়িয়ে ল্যাজ নাড়ছে। দুপুরবেলা চাকরেরা সব ঘুমিয়েছে, ঘর তাদের বন্ধ, এই সুযোগে লুকিয়ে সে একেবারে আমার ঘরের সামনে এসে হাজির | ভাবলাম, দুদিন দেখতে পায় নি, তাই বুঝি আমাকে ও দেখতে এসেছে। ডাকলাম, আয় অতিথি, ঘরে আয়! সে এলো না, সেখানে দাঁড়িয়েই ল্যাজ নাড়তে লাগল | জিজ্ঞাসা করলাম-

খাওয়া হয়েছে তো রে? কী খেলি আজ?

হঠাৎ মনে হলো ওর চোখ দুটো যেন ভিজেভিজে, যেন গোপনে আমার কাছে কী একটা নালিশ ও জানাতে চায় | চাকরদের হাক দিলাম, ওদের দোর খোলার শব্দেই অতিথি ছুটে পালাল |

জিজ্ঞাসা করলাম, হ্যা রে, কুকুরটাকে আজ খেতে দিয়েছিস?

আজ্ঞে না। মালি-বৌ ওরে তাড়িয়ে দিয়েছে যে।

আজ তো অনেক খাবার বেঁচেছে, সে সব হলো কী?

মালি-বৌ চেঁচেপুছে নিয়ে গেছে।

আমার অতিথিকে ডেকে আনা হলো, আবার সে বারান্দার নিচে উঠানের ধুলোয় পরম নিশ্চিন্তে স্থান করে নিল। মালি-বৌয়ের ভয়টা তার গেছে। বেলা যায়, বিকাল হলে উপরের বারান্দা থেকে দেখি অতিথি এই দিকে চেয়ে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে । বেড়াতে যাবার সময় হলো যে।

শরীর সারলো না, দেওঘর থেকে বিদায় নেবার দিন এসে পড়ল | তবু দিন-দুই দেরি করলাম নানা ছলে | আজ সকাল থেকে জিনিস বাঁধাবাঁধি শুরু হলো, দুপুরের ট্রেন । গেটের বাইরে সার সার গাড়ি এসে দাড়াল, মালপত্র বোঝাই দেওয়া চলল। অতিথি মহাব্যস্ত, কুলিদের সঙ্গে ক্রমাগত ছুটোছুটি করে খবরদারি করতে লাগল, কোথাও যেন কিছু খোয়া না যায়। তার উৎসাহই সবচেয়ে বেশি ।

একে একে গাড়িগুলো ছেড়ে দিলে, আমার গাড়িটাও চলতে শুরু করল | স্টেশন দূরে নয়, সেখানে পৌছে নামতে গিয়ে দেখি অতিথি দাড়িয়ে | কীরে, এখানেও এসেছিস? সে ল্যাজ নেড়ে তার জবাব দিল, কী জানি মানে তার কী!

টিকিট কেনা হলো, মালপত্র তোলা হলো, ট্রেন ছাড়তে আর এক মিনিট দেরি | সঙ্গে যারা তুলে দিতে এসেছিল তারা বকশিশ পেল সবাই, পেল না কেবল অতিথি | গরম বাতাসে ধুলো উড়িয়ে সামনেটা আচ্ছন্ন করেছে, যাবার আগে তারই মধ্য দিয়ে ঝাপসা দেখতে পেলাম- স্টেশনের ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে চেয়ে আছে অতিথি | ট্রেন ছেড়ে দিলে , বাড়ি ফিরে যাবার আগ্রহ মনের মধ্যে কোথাও খুঁজে পেলাম না। কেবলই মনে হতে লাগল , অতিথি আজ ফিরে গেয়ে দেখবে বাড়ির লোহার গেট বন্ধ , ঢুকবার জো নেই! পথে দাড়িয়ে দিন-দুই তার কাটবে, হয়তো নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নের কোনো ফাকে লুকিয়ে উপরে উঠে খুঁজে দেখবে আমার ঘরটা | হয়তো , ওর চেয়ে তুচ্ছ জীব শহরে আর নেই, তবু দেওঘরে বাসের কটা দিনের স্মৃতি ওকে মনে করেই লিখে রেখে গেলাম।

পাঠের উদ্দেশ্য

এ গল্প পড়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রাণীর প্রতি সহানুভূতিশীল হবে৷ নতুন কোনো জায়গা ভ্রমণ করলে ওই অভিজ্ঞতা লিখে রাখতেও আগ্রহী হবে।

পাঠ-পরিচিতি

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'দেওঘরের স্মৃতি' গল্পটির নাম পাল্টে এবং ঈষৎ পরিমার্জনা করে এখানে 'অতিথির স্মৃতি' হিসেবে সংকলন করা হয়েছে। একটি প্রাণীর সঙ্গে একজন অসুস্থ মানুষের কয়েকদিনের পরিচয়ের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা মমত্বের সম্পর্কই এ গল্পের বিষয় । লেখক দেখিয়েছেন, মানুষে-মানুষে যেমন স্নেহ-প্রীতির সম্পর্ক অন্য জীবের সঙ্গেও মানুষের তেমন সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু সেই সম্পর্ক নানা প্রতিকূল কারণে স্থায়ীরূপ পেতে বাধাগ্রস্ত হয় । আবার এই সম্পর্কের সূত্র ধরে একটি মানুষ ওই জীবের প্রতি যখন মমতায় সিক্ত হয় তখন অন্য মানুষের আচরণ নির্মম হয়ে উঠতে পারে। এ গল্পে সম্পর্কের এই বিচিত্র রূপই প্রকাশ করা হয়েছে।

লেখক-পরিচিতি

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কৈশোর ও যৌবনের অধিকাংশ সময় ভাগলপুরের মাতুলালয়ে অতিবাহিত হয়। তিনি কলেজশিক্ষা শেষ করতে পারেননি | ১৯০৩ সালে জীবিকার সন্ধানে রেঙ্গুন যাত্রা করেন | ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি রেঙ্গুনে ছিলেন
এবং সেখানে অবস্থানকালে সাহিত্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন । ১৯০৭ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় 'বড়দিদি' প্রকাশিত হলে তার সাহিত্যিক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে । এরপর একে একে গল্প-উপন্যাস লিখে তিনি বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকে পরিণত হন। সাধারণ বাঙ্গালী পাঠকের আবেগকে তিনি যথাযথভাবে
উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন | তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে: ‘পল্লীসমাজ’, ‘দেবদাস’, ‘শ্রীকান্ত’(চার পর্ব), 'গৃহদাহ' , 'দেনাপাওনা', 'পথের দাবী', 'শেষ প্রশ্ন' প্রভৃতি। সাহিত্য প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট, উপাধি লাভ করেন।
বাংলা সাহিত্যের এই কালজয়ী কথাশিল্পীর জীবনাবসান ঘটে ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায়।

কর্ম-অনুশীলন

ক. তোমার অভিজ্ঞতা থেকে একটি ভ্রমণকাহিনির বিবরণ লেখো (একক কাজ) |
খ. তোমার প্রিয় কোনো পশু বা পাখির কোন কোন আচরণ তোমার কাছে মানুষের আচরণের মতো মনে হয়, তার একটি বর্ণনা দাও (একক কাজ)।

ক. ভ্রমণকাহিনি: সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর

গত গ্রীষ্মের ছুটিতে, আমাদের স্কুলের পক্ষ থেকে একটি ভ্রমণের আয়োজন করা হয়েছিল। গন্তব্য ছিল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম রত্ন সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর। এই ভ্রমণ আমাদের জন্য ছিল শিখন এবং আনন্দের এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

সকালবেলা আমরা ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সুনামগঞ্জগামী ট্রেনে যাত্রা শুরু করলাম। ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা সবুজ শস্যক্ষেত্র, গ্রামের সরল জীবন, আর আকাশের মেঘগুলো যেন আমাদের চোখে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল। সুনামগঞ্জে পৌঁছানোর পর, আমরা একটি ছোট্ট নৌকায় চড়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের পথে রওনা হলাম।

হাওরে পৌঁছে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। চারদিকে বিস্তীর্ণ জলরাশি, তার মধ্যে ভাসছে শাপলা ও শালুক ফুল। দূরে দেখা যায় ছোট ছোট গ্রাম আর গাছপালা। পাখিদের কলরব যেন প্রাকৃতিক সুরের মূর্ছনা তৈরি করছিল। নৌকা নিয়ে আমরা গভীর হাওরের দিকে এগোলাম। ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ আমাদের নৌকার আশপাশে লাফাচ্ছিল। স্থানীয় মাঝি আমাদের হাওরের জীববৈচিত্র্য নিয়ে গল্প শোনালেন।

দুপুরে হাওরের মাঝখানে একটি নৌকার ওপর আমরা স্থানীয় খাবার খেলাম। ভর্তা, ভাত, আর টাটকা মাছের স্বাদ এখনো মনে পড়ে। খাওয়ার পর হাওরের জল দিয়ে মুখ ধুয়ে আমরা সতেজ হলাম। বিকেলে সূর্য যখন ডুবতে শুরু করল, হাওরের জলরাশি যেন সোনার রঙে ঝলমল করতে লাগল। এই দৃশ্য মনে হয়, সারা জীবনে ভোলা সম্ভব নয়।

ফিরে আসার সময় সবার মন কিছুটা ভারী ছিল। এত সুন্দর জায়গা ছেড়ে আসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তবে আমরা ঠিক করেছিলাম, জীবনের কোনো একদিন আবার এই শান্ত হাওরের বুকে ফিরে আসব।

এই ভ্রমণ কেবল আনন্দের জন্য নয়, আমাদের শিখিয়েছে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা এবং এর গুরুত্ব। টাঙ্গুয়ার হাওর আমার মনে এক গভীর দাগ রেখে গেছে, যা আমি কখনো ভুলতে পারব না।

খ. আমার প্রিয় পশু: কুকুরের মানুষের মতো আচরণ

আমার প্রিয় প্রাণী হল কুকুর। তাদের অনেক আচরণ আমার কাছে মানুষের মতো মনে হয়। আমাদের বাড়ির কুকুরটির নাম "টুকু," এবং তার কর্মকাণ্ড আমাকে প্রতিদিন অবাক করে।

১. ভালবাসা ও আনুগত্য
টুকুর সবচেয়ে সুন্দর বৈশিষ্ট্য হলো তার অগাধ ভালবাসা ও আনুগত্য। যখন আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরি, সে লাফিয়ে উঠে আমাকে স্বাগত জানায়। তার চোখে এমন এক উচ্ছ্বাস থাকে, যেন সে আমাকে বহুদিন পর দেখছে। এটি মানুষের প্রিয়জনকে দেখে আনন্দিত হওয়ার মতোই।

২. দুঃখ প্রকাশ করা
কখনো যদি আমি তাকে বকাঝকা করি বা খেতে দেরি করি, টুকু তার কান নিচে নামিয়ে বসে থাকে। তার এমন অভিব্যক্তি দেখে মনে হয়, সে দুঃখিত এবং আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। মানুষের দুঃখ প্রকাশের আচরণের সঙ্গে এটি অনেকটা মিলে যায়।

৩. সাহায্য করার মানসিকতা
টুকু যখন দেখে আমি কষ্টে আছি, সে আমার পাশে এসে বসে। একবার পড়ার সময় টেবিল থেকে খাতা পড়ে গেলে, টুকু তা তুলে দিতে চেষ্টা করেছিল। যদিও সে পুরোপুরি সফল হয়নি, তার সাহায্যের চেষ্টা আমার মনে দাগ কেটেছিল। এটি মানুষের সাহায্য করার মানসিকতার অনুরূপ।

৪. রাগ এবং অভিমান
যদি আমি তাকে সময় না দিই, সে রেগে গিয়ে এক কোণে গিয়ে বসে থাকে। এমনকি আমাকে উপেক্ষা করে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর যখন আমি তার মাথায় হাত রাখি, সে আবার আনন্দে লাফাতে শুরু করে। এটি অনেকটা মানুষের রাগ এবং অভিমান মেটানোর মতো।

৫. সংসারের অংশ হওয়া
টুকু আমাদের পরিবারের সদস্যের মতো আচরণ করে। যখন বাড়িতে কেউ অসুস্থ থাকে, সে তার কাছ থেকে এক মুহূর্তের জন্যও সরে না। পরিবারের প্রতি তার এই দায়িত্ববোধ আমাকে মনে করিয়ে দেয় মানুষের স্নেহ ও যত্নের কথা।

উপসংহার
কুকুরের এইসব আচরণ আমাকে প্রতিদিন নতুন কিছু শেখায়। তাদের ভালবাসা, দুঃখ প্রকাশ, সাহায্য করার চেষ্টা, এবং পরিবারকে আগলে রাখার মনোভাব একেবারে মানুষের মতো। টুকুকে দেখে আমি বুঝি, প্রাণীরাও আমাদের মতোই অনুভূতিপ্রবণ এবং সংবেদনশীল।

Resources Link:

No comments

Theme images by luoman. Powered by Blogger.